শাহ জাহান আহমেদ (মাল্টা থেকে)
অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই -প্রীতি নেই – করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া। (জীবনানন্দ দাশ )
জাদুকাটা নদী নিয়ে বিভিন্ন মিথ প্রচলিত আছে,আমি ছোট বেলা শুনছি কাউকে যদি জাদুটোনা করা হয় এবং তিনি যদি এই নদী পার হয়ে চলে যান,তবে জাদু আর কাজ করবে না অর্থাৎ জাদু কেটে যাবে,তাই জাদুকাটা নদী। সেই সময় প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। সেই মাছ সংরক্ষণের একটাই পদ্ধতি ছিল শুঁটকি দেয়া।একদিকে মাছ আসে , অন্যদিকে মহিলারা দল বেধে মাছ কাটে ।পাশে যার যার
বাচ্চা ঘুম পারিয়ে রাখে তাদের সুবিধার্থে।মাছ কাটতে কাটতে এক সময় অনেক রাত হয়ে যায়। ছোট একটি বাচ্চা হামাগুড়ি দিয়ে আসে মায়ের কাছে দুধ খেতে ,ঐ সময় তন্দ্রাচ্ছন্ন মা মাছ ভেবে ছেলেকে কেটে ফেলে এবং যখন বুঝতে পারে আমার যাদুরে বলে আহাঝারি করতে থাকে, এরকম একটি মিথ প্রচলিত আছে ।
অদ্বৈতাচার্য ও শাহ আরফিন :
বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক শ্রীশ্রী চৈতন্য দেবের (১৪৮৫-১৫৩৩) শীর্ষস্থানীয় সহচরদের অন্যতম শ্রীশ্রী অদ্বৈতাচার্য মহাপ্রভুর (১৪৩৪-১৫৫৮) সাধনার ফলেই সেখানে সাত তীর্থের সমাগম হয়েছিল বলে হিন্দুদের বিশ্বাস। শ্রীশ্রী চৈতন্যদেবের পূর্বপুরুষ সিলেট জেলার ঢাকা দক্ষিণের অধিবাসী ছিলেন। তিনি দুইবার পিতৃভূমি দর্শন করেন (হযরত শাহজালাল ও সিলেটের ইতিহাস, ১৯৮৮)। শ্রীশ্রী
অদ্বৈতাচার্য লাউড়ের রাজা দিব্য সিংহের মন্ত্রী কুবের আচার্যের পুত্র ছিলেন। তার জন্ম লাউড়ের নবগ্রামে। লাউড়েরগড় ও রাজারগাঁওয়ের মধ্যবর্তী এই গ্রাম এবং শ্রীশ্রী অদ্বৈতাচার্যের আশ্রমটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বর্তমানে নদী ভাঙনের শিকার বিন্নাকুলি ও লাউড়েরগড় বাজার এবং রাজারগাঁও, ঘাগড়া ও গড়কাটি গ্রাম।শ্রীশ্রী অদ্বৈতাচার্যের পিতৃপ্রদত্ত নাম কমলাক্ষ। তিনি নবদ্বীপে শিক্ষালাভ ওশান্তিপুরে অধ্যাপনা করেন। বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর তার নাম দেওয়া হয়
অদ্বৈত।
পঞ্চদশ শতকে তিনি ‘চৈতন্য বিষয়ক পদ’ রচনার সূত্রপাত করেন। তিনি বৈষ্ণব
সাহিত্যে শ্রীশ্রী অদ্বৈত মহাপ্রভু হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। লাউড়ের রাজা স্বয়ং তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে ‘লাউড়ের কৃষ্ণদাশ’ হন। (সুনামগঞ্জ জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য, ২০১৪)।
তরফ বিজয়ের সময় হযরত শাহ আরেফিন (র.) হযরত শাহজালালের (র.) সিপাহসালার সৈয়দ নাসিরুদ্দিনের (র.) সঙ্গী ছিলেন। তিনি হবিগঞ্জের দিনারপুর সদরঘাটে কিছুদিন
অবস্থান করেন। তার অনেক অলৌকিক ঘটনা এখনও সেখানকার লোকের মুখে মুখে প্রচলিত।
তার স্মরণে প্রতি বছর ফাল্গুন মাসের শেষ বৃহস্পতিবার সেখানে এক মেলা ও ওরসের আয়োজন করা হয়। তিনি লাউড়েরগড় যাওয়ারসময় বর্তমান সুনামগঞ্জের যে স্থানে রাত্রি যাপন করেছিলেন, সে স্থান পরবর্তী সময়ে আরফিননগর নামে অভিহিত হয় বলে জনশ্রুতি রয়েছে।পরে তিনি লাউড়ের গড় গ্রামের কাছে খাসিয়া পাহাড়ের চূড়ায় আস্তানা গাড়েন এবং তদানীন্তন লাউড় রাজ্যে ইসলাম প্রচারে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। লাউড় অঞ্চলের লোকেরা এই সাধু পুরুষের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। প্রতি বছর পণাতীর্থ মেলার তারিখের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তার ওরস পালিত হয়। মুসলমান, হিন্দু,বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, পাহাড়ি ও বাঙালি ভক্তরা তার স্মৃতি বিজড়িত লাউড়েরগড়
সীমান্তে সমবেত হন।
সব ধর্মেই অলৌকিক ঘটনাবলির বর্ণনা রয়েছে।পণাতীর্থ সম্পর্কেও এমনি একটি ঘটনার কথা সর্বজন বিদিত। শ্রীশ্রী অদ্বৈতাচার্যের শিষ্য ইশান নাগরের জন্ম লাউড়ের নবগ্রামে। তিনি মহাপ্রভুর জীবনী রচনা করেন ১৫৬৮সালে।বাংলা ভাষায় রচিত ইশান নাগরের এই গ্রন্থের নাম ‘অদ্বৈত প্রকাশ’।সমালোচকদের মতে, ‘চৈতন্যচরিত’ গ্রন্থাবলির পরেই মধ্যযুগের সাহিত্যে ‘অদ্বৈত প্রকাশ’একটি উল্লেখ যোগ্য জীবনী গ্রন্থ।ইশান নাগর তার এই কালজয়ী গ্রন্থে পণাতীর্থের উৎপত্তি বর্ণনা করেছেন। অদ্বৈত প্রভু বা কমলাক্ষের বয়স যখন ৭ বছর তখন তার মা লাভা দেবী এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেন। তিনি দেখেন, তিনি নানা তীর্থজলে স্নান করছেন।রাতের শেষ প্রহরের স্বপ্ন সঠিক হয় বলে সবাই বিশ্বাস করত। তবু ভোরে লাভা দেবীএ স্বপ্ন নিয়ে চিন্তা করে বিমর্ষ হলে কমলাক্ষ তার কারণ জানতে চান। তিনি স্বপ্নের কথা তাকে খুলে বললে বালক কমলাক্ষ পণ বা প্রতিজ্ঞা করলেন, সেখানেই সব তীর্থের আবির্ভাব ঘটাবেন।ইশান নাগর লিখেছেন, ‘প্রভু কহে আজি নিশায় আসিবে সর্ব্বতীর্থ;/কালি স্নান করি
সিদ্ধ করিও সর্ব্বার্থ।/ নাভা কহে এই কথা কে করে প্রত্যয়;/ প্রভু কহে এই কথা
সত্য সত্য হয়।/ তবে নিশাকালে প্রভু করিয়া মনন,/ যোগে তীর্থগণে তবে কৈলা
আকর্ষণ।/ যৈছে লৌহগতি অয়স্কান্ত আকর্ষণে;/ তৈছে তীর্থগণ আইলা ঈশ্বর স্মরণে।/
মূর্ত্তিমতি শ্রীযমুনা গঙ্গা আদি তীর্থ,/ প্রভুরে পূজিয়া সবে হইলা কৃতার্থ।’/
‘প্রভু কৈল মধুকৃষ্ণ ত্রয়োদশী যোগে,/ সকলে আসিয়া পণ কর মোর আগে।/ তীর্থগণ কহে
মোর সত্য হৈলু পণ,/ তব শ্রীমুখের আজ্ঞা না হবে লঙ্ঘন।/ তদবধি পণাতীর্থ হৈল তার
নাম।/ গণাবাহনে সিদ্ধ হয় মনস্কাম’। (অদ্বৈত প্রকাশ দ্বিতীয় অধ্যায়)। অর্থাৎ
মনঃশক্তির অসীম প্রভাব ও অসাধারণ যোগবল শক্তির বলে অদ্বৈতাচার্য তীর্থদের
লাউড়ের এক ক্ষুুদ্র শৈলের ওপর নিয়ে এলেন। ওই শৈলখণ্ডের একটি ঝরণা তীর্থবারি
পরিপূরিত হয়ে ঝরঝর করে পড়তে লাগল। অদ্বৈত জননী সেখানে স্নান করে পরিতৃপ্ত
হলেন । (শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত পূর্বাংশ, ১৯১০/২০০৪)
বাংলাদেশের আকর্ষণীয় তথা মন ভোলানো নদীগুলোর মধ্যে যাদুকাটা শীর্ষস্থানীয়। এর পানি এতই স্বচ্ছ যে, খালি চোখে ময়লা বা আবর্জনাবিহীন নদীর তলদেশ দেখা যায়।শতাধিক বছর আগে অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি লাউড়ের এই এলাকা সম্পর্কে লিখেছেন :’এই স্থান প্রকৃতির এক রম্য নিকেতন। নীলায়ত পর্বত, চঞ্চল নির্ঝরিণী, সুজল হ্রদ বা কু- এবং শ্যামল কানন শোভা বড়ই প্রাণারাম। এ স্থানে গেলে স্থান মাহাত্ম্যে মন কোনো অজানিত দেশে যেন চলিয়া যায়, মনে বাঁধ যেন ভাঙ্গিয়া যায়, মনে স্বভাবতই ভগবৎ ভক্তির উদয় হয়। অধিক বলিয়া প্রয়োজন নাই, লাউড়ের বিবরণ প্রসঙ্গে জনৈক সম্ভ্রান্ত মুসলমান লেখক লিখিয়া পাঠাইয়াছেন :’এ স্থানে প্রকৃতিরশান্তিময়ী কান্তি অবলোকনে আত্মহারা হইতে হয়,এ স্থানে আত্মীয় বিয়োগ ও অপ্রিয় সংযোগ জনিত সংসারের জ্বালা যন্ত্রণা মনে থাকে না।’ (শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত
পূর্বাংশ, ১৯১০/২০০৪)।কৃতজ্ঞতা স্বীকার (সমকাল, হাসান শাহরিয়ার)
ক্রমশ–
কমেন্ট করুন