আফতাব চৌধুরী
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল স্কুলের স্বাস্থ্য বিষয়ক একটি বিশেষ প্রতিবেদন থেকে জানাযায়-শুধু সৃজন নয়, বিজ্ঞান সম্মত ভাবে দৈনন্দিন জীবন-যাপননয়, শুধু নির্মল পরিবেশে বসবাস করা নয়- সম্মিলিত ভাবে এই তিনটির মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে দীর্ঘ জীবনের রহস্য।গত একশো বছরে বিশেষত উন্নত দেশ গুলোর মানুষের গড় আয়ু অনেকটাই বেড়েছে। কিন্তু আমাদের জিন একশো বছর আগে যেমন ছিল আজকে তার থেকে কি পরিবর্তন হল? তাহলে আয়ুটা বাড়লো কীভাবে? নিঃসন্দেহে বিজ্ঞান সম্মত ভাবে দৈনন্দিন জীবন-যাপন এবং নির্মল পরিবেশে বসবাস,মানুষকে দীর্ঘ জীবনের পথে এগিয়ে দিয়েছে। প্রসঙ্গত ‘আমেরিকান জার্নাল অফ মেডিসিন’Ñ এ প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, শুধুমাত্র দৈনন্দিন জীবন যাত্রার কাঙ্কিত পরিবর্তন এনে মৃত্যু হার প্রায় ৪০ শতাংশ কমানো গিয়েছে। সুতরাং লম্বা আয়ুর লক্ষ্য জিন সম্পর্কিত গবেষণার পাশাপাশি এই দুটি বিষয়ের উপর সবিশেষ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। কারণ এ দুটি আমরা অপেক্ষা কৃত সহজে নিজেদের জীবনে যোগ করতে পারি।তাই আপনার বয়স কত, বা জীবনের কোন পর্যায়ে আপনি রয়েছেন, তা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করার কোনও প্রয়োজন নেই। চাইলেই আপনি পেতে পারেন একটি দীর্ঘ স্বাস্থ্যময়, আনন্দমুখর সুখী জীবন।
কীভাবে শুরু করবেন? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, হার্ভাড মেডিকেল স্কুল,বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন প্রভৃতি স্বাস্থ্য সংস্থা গুলো সুস্থ ও দীর্ঘ জীবনের লক্ষ্যে বিভিন্ন সময়ে নানা রকম মতামত দিয়েছেন। এগুলোকে যুক্ত করলে বিষয়টি মোটামুটি দাঁড়ায় এই রকম। ক্যানসার প্রবণতা রয়েছে,জ্ঞাত এমন সমস্ত বিষয় গুলো যথাসাধ্য এড়িয়ে চলুন।যেমন কোনও ভাবে তামাক সেবন করবেন না।কারণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানাচ্ছে ধুমপান স্বাস্থ্য ও আয়ুঙ্কালের উপর সাধারণ ভাবে নেতিবাচক প্রভাবই ফেলে। ইউনিভার্সিটি অফ অক্সফোর্ডের গবেষকরা ২০১৬ সালের অক্টোবরে ব্রিটিশ মহিলাদের উপর গবেষণায় দেখেছেন যে, যাঁরা অন্তত ৪০ বছর বয়সের আগে সিগারেট ছেড়ে দেন,তাঁরা অতিরিক্ত ৯০ শতাংশ ক্যানসার মৃত্যু-সম্ভাবনা এড়াতে পারেন। সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বাঁচতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন। ‘প্রোটেকশন’ছাড়া সরাসরি রোদে বেশিক্ষণ না থাকাই ভালো। মোবাইলটা ওয়ার সহ অন্যান্য ক্ষতিকর বিকিরণ স্থল এবং বিপদজ্জনক দূষণ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকুন। দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাসের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করুন। পুষ্টিকর দানাশস্য, শাক সবজিফলও ফাইবার জাতীয় টাটকা ও হাল্কাখাদ্য উপযুক্ত পরিমাণে খাদ্য তালিকায় রাখুন। প্রয়োজন মত পানি, ফলের রস বা অন্য কোনও স্বাস্থ্যকর পানীয় গ্রহণ করুন।স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর‘স্যাচুরেটেড ফ্যাট’ যেমন রয়েছে ঘি, মাখন, ইত্যাদি এড়িয়ে চলুন। এড়িয়ে চলুন Ñ অনুমোদিত রং দেওয়া ও অন্যান্য অস্বাস্থ্যকর খাবার-দাবার। ক্যালোরি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টা মাথায় রাখুন। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের ‘দ্য ইন্সটিটিউট অব হেলথ এজিং-এর গবেষকরা বলেছেন Ñ ‘৪০শতাংশ কম খান, বাঁচবেন বহুদিন...” ‘ইন্টার মাউন্টেন মেডিকেল সেন্টার অবহার্ট ইন্সটিটিউট’Ñএর গবেষক-চিকিৎসকরা বলেছেন Ñ নিয়মিত উপোস করুন নিয়ন্ত্রণে রাখুুন শরীরের ওজন,ক্ষতিকর কোলেস্টরল এবং সুগারের পরিমাণকে কমিয়ে রাখুন,দূরে রাখুন হৃদরোগকে।সুতরাং এত কিছু নিয়ে ভাবতে পারলে ভাবুন, ক্ষতি নেই। তবেনা-পারলে ক্যালরিটা শুধু একটু মেপে খাওয়া-দাওয়া করুন।কারণ ‘ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া,বার্কলে’র পুষ্টিবিদ ডঃ হেলারস্টেন-এর গবেষণা অনুযায়ী ক্যালোরি নিয়ন্ত্রণ শুধুমাত্র যে রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে তাই নয়,এটি মানুষের জীবনকালকেও দীর্ঘায়িত করে।
প্রতিদিনের খাদ্য উপযুক্ত পরিমাণে রাখুন বিভিন্ন ধরণের ভিটামিন ক্যালসিয়াম ও বিভিন্ন ধরণের খনিজ এবং অ্যান্টি অক্সিড্যান্ট। চা, ডার্ক চকোলেট শুধু ‘অ্যান্টি অক্সিডেন্ট’-ই জোগায়না,ক্যানসার, হৃদরোগ প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের প্রাণঘাতী রোগ থেকে দূরে রাখে এবংসব থেকে বড়কথা বার্ধক্যকে অনেক টারুখে দেয়।তবে নিয়মিত ভাবে চা বা কোনও কিছুই গরম খাবেন না।এতে করে খাদ্যনালীর ক্যানসারের সম্ভাবনা বাড়বে। খেয়াল রাখা উচিত কোনও রকমের খাদ্য বা পানীয়ের প্রতি যেন মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি বা নির্ভরতা তৈরি নাহয়।
শরীরের সঠিক ওজন ও গঠন বজায় রাখতে প্রত্যেক দিন নিয়ম করে বিভিন্ন রকম শরীর চর্চা কিছু না কিছু পরিমাণ অবশ্যই করুন। জাপানের মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন মনে করে,এর ফলে আপনার হৃদযন্ত্র ও ফুসফুস ভালো থাকবে। রক্তচাপ, বডিফ্যাট,খারাপ কোলেস্টরল,মানসিকচাপ ও অবসাদ কমবে,কমবে হাড়ের আঘাত ও জয়েন্ট সমস্যা জনিত ঝুঁকি।নিয়ন্ত্রণে থাকবে বা প্রতিরোধ করা যাবে ডায়াবেটিসকে,বাড়বে এনার্জির পরিমাণ,ঘুম ভালো হবে,পেশিশক্তি বাড়বে, বাড়বে আত্মবিশ্বাস ও ব্যক্তিত্ব,সার্বিক ভাবে আপনার ভালো লাগবে এবং আপনাকে ভালো দেখাবে। নিয়মিত শরীর-চর্চা বয়স্ক মানুষদের অসুস্থতা থেকে অনেকটাই দূরে থাকতে সাহায্য করে।
দীর্ঘ গবেষণার ভিত্তিতে আমেরিকার যুক্তরাষ্টের ওয়েন ইউনিভার্সিটির বিশেষজ্ঞরা দাবি করছেন, সত্যিকার হাসি-খুশি থাকলে বাড়বে আয়ু। আর বোস্ট ইউনিভার্সিটি মেডিকেল সেন্টারের বিশেষজ্ঞরা বলছেন,যদি বেশি দিন বাঁচতে চান তবে উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা কমিয়ে ফেলুন ।
কিন্তু কীভাবে? বেঁচে থাকার একটা উদ্দেশ্য বা অর্থ খুঁজে নিন আপনার মত করে। হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল সূত্রে জানাযায়, নৈরাশ্য বাদীদের মধ্যে মৃত্যুহার ৪২ শতাংশ বেশি। সুতরাং আপনি বয়স্ক হলেও বয়স হয়ে যাওয়া বা বয়সের অনিবার্য লক্ষণ গুলোকে নিয়ে অযথা হতাশ হবেন না বা বিড়ম্বনায় পড়বেননা। এগুলো সবার ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক অনিবার্যতা ধরে দিয়ে,নতুন প্রজন্মের সঙ্গে কৌতুক, পারস্পরিক সম্মান, ব্যক্তিত্বের সৌন্দর্য এবং প্রয়োজনীয় স্পেস দিয়ে বার্ধক্যের ধূসরতায় সবুজ প্রাণের সঞ্চার করুন। এ বছর ‘দ্য নিউইয়র্ক টাইমস’এর একটি প্রাসঙ্গিক প্রতিবেদনেও স্পষ্ট করা হয়েছে, বয়স হয়ে যাচ্ছে এজন্য দুশ্চিন্তা করে সময় নষ্ট নয়, সামাজিক যোগাযোগ বজায় রাখুন, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়াকে এড়ান।নিজেকে ক্রমাগত আরও শিক্ষিত করে তুলুন।
প্রকৃত শিক্ষাই মানুষকে জীবনমুখী ও দীর্ঘ জীবনের অধিকারী করে গড়ে তুলতে পারে। কারণ শিক্ষাই আপনাকে প্রকৃতি ও পারিপার্শিক পরিবেশের নানা ঘাত-প্রতিঘাত ও জটিলতার সঙ্গে সঠিক ভাবে মানিয়ে নিয়ে চলতে শেখায়। এড়াতে পারা যায় অনেক অবাঞ্ছিত ঘটনা ও বিপদ। চলাফেরার ক্ষেত্রে কখনও অন্যমনস্কতানয়, সব সময় উপযুক্ত সতর্কতা নিন। নিজের সার্বিক স্বাস্থ্য সম্বন্ধে সতর্ক থাকুন। দীর্ঘায়ু চাইলে নির্মল পরিবেশে, পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে থাকতে হবে। পরিশ্রম ও বিশ্রাম বিশেষত ঘুম যেন প্রয়োজন মত হয়। গভীর ভাবে শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রিয়া চালান। বিষয়টি অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা জরুরি। আপাত সুস্থ মানুষদেরও বছরে অন্তত একবার প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরীক্ষা জরুরী। এ ছাড়া কোলেষ্টেরল কমানো, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ বা অস্টিওপোবোসিস-এর চিকিৎসা Ñ যে-কোনো চিকিৎসার প্রয়োজনে সব ক্ষেত্রেই স্বীকৃত কোনও চিকিৎসকের পরামর্শ ও সাহায্য নিন।দাঁত নিয়মিত ব্রাশ করা ও মুখের ভিতরটা সব সময় পরিচ্ছন্ন রাখা দরকার। না-হলেএর ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে পুষ্টির উপর। এমনকি দাঁতের মধ্যে থাকা ব্যাক্টেরিয়া প্রভাব ফেলতে পারে হৃদযন্ত্রের উপরেও। অন্তত এমনটাই জানাচ্ছে হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল। একই সঙ্গে মনে রাখা দরকার প্রাতঃকৃত্যাদির নিয়মিত ও সঠিক অভ্যাসে স্বাস্থ্যের বিভিন্ন উপকারের সঙ্গে কোষ্ঠ পরিষ্কারের সমস্যা দূর হবে এবং কলোরেকটাল ক্যানসারের সম্ভাবনা থেকে দূরে সরে থাকবেন।
পৃথিবীর যে দেশগুলো দীর্ঘ দিন ধরে গড় আয়ুর ক্ষেত্রে প্রথম সারিতে রয়েছে সেগুলো হল জাপান, সিঙ্গাপুর, হংকং, অষ্ট্রেলিয়া, ইতালি ইত্যাদি। তাৎপর্য পূর্ণ ভাবে আর্থিক দিক থেকে দেশ গুলো সামনের সারিতেই রয়েছে। প্রসঙ্গত ‘ওয়াল্ড ব্যাঙ্ক’-এর একটি প্রতিবেদনের মতে, মানুষের আয়ুর উপর দারিদ্রের একটা নেতিবাচক প্রভাব আছে। তাই আর্থিক ভাবে সমৃদ্ধ দেশ গুলোতে সাধারণ ভাবে মানুষের আয়ুও অনেকটা বেশি। যাই হোক, এই দেশগুলোর মধ্যে আমাদের এশিয়ার দেশ জাপান নিঃসন্দেহে উল্লেখ যোগ্য। জাপানিরা গড়ে প্রায় ৮২ বছর বাঁচে এমনটাই কিন্তু মনে করেন ইউনিভার্সিটি অফ টোকিও-র ডিপার্টমেন্ট অফ গোবেল পলিসি-র অধ্যাপ কশিবুয় এবং তাঁর সহকর্মীরা।
তাঁরা গবেষণা করে দেখেছেন যে, জাপানিরা যথেষ্ট স্বাস্থ্য সচেতন এবং আগ্রহের সঙ্গে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে । ঘটনা চক্রে, গিনেসওয়ার্ল্ডং রেকর্ডের অধিকারী ১১৫ বছর অতিক্রম কারী বিশ্বের প্রাচীনতম জীবিত মানুষ জিরো মনকি মুরাও একজন জাপানি।আসুন আমরাও বেঁচে থাকার চেষ্টা করি আরও বহুদিন এই সুন্দর আনন্দময় পৃথিবীতে ।
লেখক-সাংবাদিক,কলামিষ্ট।
কপি রাইটসঃ লাউড় বিডি নিউজ ২৪