নিউজ ডেস্ক ঃ- ‘সে এক রূপ কথারই দেশ, ফাগুন যেথা হয় না কভু শেষ’এই গানের কলি যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে তাহিরপুর উপজেলায় অবস্থিত বাংলাদেশের সর্ববৃহত শিমুলবাগানে।সেখানে গেলে লিখতে হবে নতুন গান সে এক ফাগুনেরই বন,শিমুল যেথা রাঙায় সবার মন।
সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের শিমুল বাগানে এখন এভাবেই প্রকৃতি যেন গাইছে ফাগুনের গান।১৪ ফেব্রুয়ারী বিশ্ব ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে ছিল হাজারো মানুষের উপস্থিতি তাহিরপুরের এই শিমুল বাগানে।প্রেমিক-প্রেমিকা,স্বামী-স্ত্রী,পরিবার-পরিজন,স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্ব্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের উপচেপড়া ভীড়,কেউ টিকটক,কেউ কবিতা আবৃতি,আবার কপোত কপোতির শিমুল ফুলে সাজানো ভালোবাসার নীড়ে ছবি উঠাতে মসগুল।
প্রথমে ৩০ টাকা মুল্যের টিকিট কিনে শিমুলবনে প্রবেশের পর প্রথমেই চোখে পড়ে চ্যামেলী নামে এক ৮বছর বয়সী একটি শিশুকে,সে তার নিজের মত করে শিমুলের ঝরা ফুলগুলো দিয়ে লাভ চিহ্ন একেঁছে। সেই লাভ চিহ্নের ভিতরে প্রবেশ করিয়ে ছবি উঠিয়ে টাকা নেয় সে ১০ টাকা। আবার কেউ কেউ খুশি হয়ে বেশি টাকাও দেয় বলে জানায় চ্যামেলী।
ভালোবাসা দিবসকে স্বরণীয় করে রাখতে কৃষিবিদ মহিদুল ইসলাম সিলেটের চুনারুঘাট থেকে স্বস্ত্রীক এসেছেন শিমুল বাগানে,সাথে তাদের একমাত্র রাজ কন্যা মার্শিহা ইসলাম মেহা। চুনারু ঘাট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হিসাবে কর্মরত তিনি। কৃষি কর্মকর্তা মহিদুল জানালেন অসম্ভব সুন্দুর এই শিমুলবনের উপমা দেশের আর কোথাও নেই তাই সময় পেয়ে ছুঠে আসা।অত্যন্ত নিরিবিলি পরিবেশ যেন প্রকৃতির অপরুপ সুন্দর্য মন্ডিত।ঢাকা থেকে পরিবারের লেকজন সহ ভালোবাসা দিবসে ঘুরতে এসছেন শিক্ষক আনিসুজ্জামান।উনার সাথে ৭ সদস্যের একটি টিম গতকাল রাতে ঢাকা থেকে রওয়ানা দিয়ে নিজের গাড়ি করে সকালে নদীর ওপাড়ে লাউড়ের গড় নদীরপাড় গাড়ি রেখে পেরিয়ে এসেছেন শিমূল বনে।এখানকার পরিবেশ দেখে তিনি মুগ্ধ।তিনি বলেন ক্লান্তি গুলো যেন ঝরে গেছে। স্ত্রী-সন্তানেরাও খুব খুশি। এত বড় শিমুল বাগান এর আগে কোথাও দেখেননি বলে জানান তিনি।
শিমুল বনের পাশের গ্রাম শান্তিপুর থেকে ১৩ জনের একদল শিশুকে রঙ্গিন শাড়িতে সজ্জিত করে শিমুল বনে ঘুরতে নিয়ে এলেন পারুল বেগম। পারুল বেগমের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, লাল শাড়ি পড়া বাচ্ছাদের নিয়ে অনেকে ছবি তুলতে ভালবাসেন ।একই রকম রঙ্গিন সাজে সাজতে পেরে শিশুরাও খুবই খুশি।
স্বামীর সাথে ঘুরতে এসেছেন শিমুল বনে স্থানীয় এলাকার লিপি বেগম শিমুল ফুলের পাশাপাশি হালকা লাল রঙের ফুল পেয়ে তিনি খুশিতে লাফিয়ে উঠলেন।উনার পছন্দের রঙের শাড়ির সাথে ফুলটি ম্যাচ করছ বলেই তার সীমাহীন আনন্দ বলে জানালেন বিজিবিতে কর্মরত স্বামী শাহিন আলম।
তাহিরপুরে এই বিশাল সে শিমুল বাগানের একপ্রান্তে দাঁড়ালে অন্যপ্রান্ত দেখা যায়না। সারিবদ্ধভাবে এত পরিকল্পনা করে বাগানটি তৈরি করা,না দেখলে এর সৌন্দর্য আঁচ করা কষ্টকর। ডালে ডালে মধু খেতে আসছে বুলবুলি, কাঠশালিক,হলদে পাখিরা।পাখির কিচির মিচির ডাক ছড়িয়ে পড়েছে গোটা বাগানে। থেকেথেকে ফোটা ফুল মাটিতে পড়ছে,থপ করে শব্দ হচ্ছে,এ যেন সত্যিই রূপকথার এক রাজ্য।
জয়নাল আবেদীন শিমুল বাগানে ক্যান্টিনে কফি খেতে খেতে আলাপ হলো এই বাগানের প্রতিষ্ঠাতা হাজী জয়নাল আবেদীনের ছেলে সাবেক চেয়ারম্যান আফতাব উদ্দিনের সাথে। আফতাব উদ্দি বললেন,আমার বাবা বাদাঘাট (উত্তর) ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন ১৯৯৮ সালে নিজের প্রায় ২ হাজার ৪’শ শতক জমি বেছে নিলেন শিমুলগাছ লাগাবেন বলে। সে জমিতে তিনি প্রায় তিন হাজার শিমুল গাছ লাগালেন। দিনে দিনে বেড়ে ওঠা শিমুল গাছগুলো রুপ নিয়েছে শিমুলবাগানে। মূলত তাঁর মাথায় ছিল এমন একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তুলবেন,যা হবে দেশের অনন্য বেড়ানোর জায়গা।সেই সাথে শিমুল বাগানের কাছাকাছি টাঙ্গুয়ার হাওর,শহিদ মুক্তিযোদ্ধা সিরাজ লেক,ট্যাকেরঘাট খনি প্রকল্প, বড়গোফটিলা, যাদুকাটা নদীটিও মেঘালয় পাহাড় সহজে দেখার সুযোগ পাবে পর্যটকরা।একসময় সীমান্ত এলাকা দুর্গম থাকলেও এখন যোগাযোগ ব্যবস্থার কিছুটা সহজ হওয়ায় প্রায় সারাবছরই লোক সমাগম থাকে পর্যটন সমৃদ্ধ তাহিরপুর সীমান্তে। আমরা পর্যটকদের উপযোগী একটি রিসোর্ট নির্মাণের পরিকল্পনাও হাতে নিয়েছি।এছাড়া যাদুকাটা নদীর তিন মোহনায় একটি সুউচ্চ ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণের চেষ্টা করব,যাতে এখানে আসা পর্যটকরা পূর্ণ মাত্রায় আনন্দ উপভোগ করতে পারেন।
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান করুনা সিন্ধু চৌধুরী বাবুল বলেন,৩৬০ আউলিয়ার পুণ্যভুমি হযরত শাহ আরেফিন(রহঃ)ও মহাপ্রভু অদ্বৈত্য ধামের মধ্যস্থানে অবস্থিত হাজী জয়নাল আবেদীন শিমুল বাগান, এই বাগানের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন একজন প্রকৃত সমাজ সেবক যিনি আজন্ম মানুষের কল্যানে কাজ করে গেছেন। তার স্মৃতিকে ধরে রাখতে হলে তার সৃষ্টিকে বাচিয়ে রাখতে হবে বলে মনে করি।
কমেন্ট করুন