উপজেলা প্রতিনিধি মধ্যনগরঃ- শিক্ষা-দীক্ষায় অগ্রসর,সরকারকে রাজস্ব প্রদানের দিক থেকেও
এগিয়ে থাকা জনপদের নাম মধ্যনগর।
দীর্ঘদিন নিজেদের চাওয়া থেকে বঞ্চিত ছিলেন এ জনপদের লোকজন।
প্রায় ৩৮ বছর পর হাওর-ভাটির বঞ্চিত এই অঞ্চলবাসীর প্রাণের দাবি বাস্তবায়ন হওয়ায় নতুন করে স্বপ্নদেখা শুরু করেছেন তারা।
১৯৮৩ সাল থেকেই মধ্যনগরকে উপজেলায় রূপান্তর করার দাবি ওঠে। উপজেলা ঘোষণাও হয়। নিকাবে’র বৈঠকে অনুমোদনও হয়।পরে রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় বাতিল হয় এ উপজেলা বাস্তবায়ন কার্যক্রম।
মধ্যনগর উপজেলা বাস্তবায়ন কমিটির প্রতিষ্ঠাকালিন আহ্বায়ক সুকেশ রঞ্জন সরকার বললেন,১৯৮৩ সালে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ যখন ক্ষমতায় তখন সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা ঘোষণা হয়। মধ্যনগরকে উপজেলা করার কথা। তখন ঘোষণা দিয়েও বাতিল করা হয়। কাদের বাহিনীর সদস্য ছিলাম বলে আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। আমি তখন কারাগারে। কারাগার থেকে বের হয়ে এই বিষয়ে নানাজনের সঙ্গে কথা বলা শুরু করি। প্রতি মুহূর্তে এই বঞ্চনার বিষয়টি নিয়ে মন খারাপ হতো আমার। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৯ সালে মধ্যনগর উপজেলা দাবির আন্দোলন সার্বজনীন আন্দোলনে রূপ নেয়।লাগাতার আন্দোলন সংগ্রামের এক পর্যায়ে এই ইস্যুতে মধ্যনগরের সংগ্রামী দুই/তিনশ’মানুষ রাজধানীতে গিয়ে অবস্থান নেবারও চিন্তা করেন। হয় উপজেলা, না হয় স্বেচ্ছায় কারবরণের সিদ্ধান্তও গ্রহণ করেন তারা। তখনকার স্থানীয় সংসদ সদস্য সৈয়দ রফিকুল হক এবং জাতীয় নেতা আব্দুস সামাদ আজাদ আন্দোলনকারীদের সঙ্গে এই নিয়ে কথা বলেন। তারা দুইজন ২০ দিনের সময় চেয়ে নেন এবং দুইজনেই এই বিষয়ে ডিও লেটার দেন। এক পর্যায়ে ২০০১ সালের ৯ম নিকারের ৮৬তম বৈঠকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মধ্যনগর থানাকে উপজেলায় রূপান্তরিত করার জন্য অনুমোদন দেন। কিন্তু ২০০৩ সালের ১৮ জানুয়ারি নিকারের ৮৮তম বৈঠকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এই অনুমোদনটি বাতিল করে দেন। এ অবস্থায় মধ্যনগরের চার ইউনিয়নের বাসিন্দাদের স্বপ্ন ভেঙে যায়। এতো বছর পর গত সোমবার ১১৭ তম নিকার সভায় মধনগরকে উপজেলা ঘোষণায় আমি ভীষণ খুশী।
যেভাবে এই জনপদের পরিচিতি-ঃ
মধ্যনগরের বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষানুরাগী সুধাংশু রঞ্জন সরকার এবং মধ্যনগরের বাসিন্দা জেলা সিপিবির সভাপতি চিত্তরঞ্জন তালুকদার জানালেন, পৌনে দুই’শ বছরেরও আগে প্রমত্তা ঘুমাইনদী ও উবদাখালী নদীর সংযোগস্থলে বিশাল পাক (কোল্লা) ছিল। পশ্চিম দিকের গ্রাম ছিল বৈঠাখালী, পূর্বদিকে পিপড়াকান্দা, দক্ষিণ দিকে গলইখালি এবং উত্তর দিকে মধ্যনগর গ্রাম। একসময় উবদাখালি ও গোমাই নদীর মোহনায় চর জাগে। আশপাশের জেলেরা ওখানটায় এসে বসে মাছ বিক্রি করতেন। ঘোষ পরিবারগুলো দৈ বিক্রি করতো। এই দুই সম্প্রদায়ের ব্যবসায় এখানে বাজারের মতো পরিবেশের উদ্ভব হয়। সেই স্থানটিকে মাঝের চর হিসাবেই তখন চিনতেন সাধারণেরা।
বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ময়মনসিংহের গৌরিপুরের জমিদার দুর্গাপুরের মহারাজার কাছ থেকে বংশিকুন্ডার পরগনা ক্রয় করেন। মধ্যনগর বংশিকুন্ডা পরগনার অন্তর্ভূক্ত ছিল। গৌরিপুরের জমিদার মাঝের চরে বাজার গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন স্থান থেকে বণিক, নাপিত ও শুক্লবৈদ্যসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকজনকে নিয়ে আসেন। শব্দের বিবর্তনে তখন মাঝেরচর-মাঝিরচর-মাঝিপাড়া-মাইজপাড়া থেকে মধ্যনগর নামে পরিচিতি পায়। ওই সময়েই হবিগঞ্জের সানদাক এলাকা থেকে আনন্দ বর্মণ নামের একজন মৎস্যজীবী এখানে এসে বসতি স্থাপন করেন। তিনি দাদন ব্যবসাও করতেন। আনন্দ বর্মন গৌরিপুরের জমিদারের কাছ থেকে দানসূত্রে বাজারের কিছু ভূমি পান। বিত্তশালী ও কিছুটা প্রভাব থাকায় আনন্দ বর্মনের নামে মধ্যনগর আনন্দগঞ্জ বাজার নামেও কিছু দিন পরিচিত ছিল। কিন্তু পাকিস্তান হবার পর আবার এই জনবসতির নাম হয় মধ্যনগর। যা এখনো আছে এবং উপজেলাও হয়েছে এই নামেই।
রাজস্ব আয়ে সমৃদ্ধ অঞ্চল
মধ্যনগর সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রবীর বিজয় তালুকদার জানালেন, উত্তরে ভারতের গারো পাহাড়, পূর্বে জেলার জামালগঞ্জ ও তাহিরপুর উপজেলা, দক্ষিণে জেলার ধর্মপাশা ও নেত্রকোণার বারহাট্টা এবং পশ্চিমে নেত্রকোণার কলমাকান্দা উপজেলা। বর্তমানে চার ইউনিয়নে ২৫৮ বর্গ কিলোমিটার আয়তনে ১১৮ টি গ্রাম। জনসংখ্যা এক লাখ ৮৫ হাজার প্রায়। রামসার সাইট টাঙ্গুয়ার হাওরের একাংশও এই নতুন উপজেলায় পড়েছে। জেলার বড় বড় জলমহাল, যেগুলো থেকে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়, সেগুলোর মধ্যে বাইমচাপড়া, রূপেস্বর, গোয়ালা, ঘোড়াডুবা, শালদিঘা মধ্যনগরের সীমানায়। সুনামগঞ্জ জেলায় সবচেয়ে বেশি ৭৩ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে গত অর্থবছরে মধ্যনগর বাজার থেকে। এক সময় শুকনা মাছ এবং গভ্য ঘৃতের জন্য মধ্যনগরের সুখ্যাতি ছিল। এখন হাওরাঞ্চলের সবচেয়ে বড় ধানের আড়ৎ এটি।
যাদের জন্য খ্যাতি বেড়েছে
অগ্নিযুগের প্রয়াত বিপ্লবী কমরেড লাল মোহন দাসের বাড়িও ছিল এই জনপদের চামরদানী ইউনিয়নের কায়েতকান্দা গ্রামে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনেও সক্রিয় ছিলেন এই রাজনীতিক। ২০১৬ সালের ৩ জুন ১০৪ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন তিনি। মধনগরের বংশিকুন্ডার অবসরপ্রাপ্ত সচিব এমএ গণি, চাপাইতির বাসিন্দা সাবেক তথ্য সচিব বর্তমানে প্রধান তথ্য কমিশনার মরতুজা আহমদ, ধাতিয়াপাড়ার বাসিন্দা ডিআইজি আব্দুল বাতেন, সাড়ারকোনার বাসিন্দা সিলেট শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. রমা বিজয় সরকার, মধ্যনগর গ্রামের বাসিন্দা বাংলাদেশ ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর গোলাম হায়দার, আনন্দ মোহন কলেজের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মধ্যনগরের বাসিন্দা দীপচান কানু, সাড়ারকোনার বাসিন্দা ইউএনডিপির প্রতিনিধি ড. শ্যামল রায় চৌধুরী, চাপাইতির বাসিন্দা শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. মুশতাক আহমদ, চামরদানির বাসিন্দা মেজর সোলায়মান, মজলিশপুরের বাসিন্দা সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর নিলীমা চন্দ, কেন্দ্রীয় মানসিক হাসপাতালের পরিচালক ডা. বিধান চন্দ্র রায় পোদ্দার, কর কমিশনার রঞ্জিত সরকার, অধ্যাপক সুধাংশু সরকারসহ অসংখ্য গুণী মানুষের কর্মে মধ্যনগরের সুখ্যাতি ছড়িয়েছে। মধ্যনগরের দুগনই গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল আউয়াল তালুকদার ধর্মপাশা উপজেলা পরিষদে দুইবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন।
অঞ্চল আলোকিত করেছে যে প্রতিষ্ঠান
ময়মনসিংহের গৌরীপুরের জমিদার ব্রজেন্দ্র কিশোর চৌধুরী নিজের মায়ের নামে ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠা করা মধ্যনগর বিশ্বেশ্বরী পাবলিক হাইস্কুল এ- কলেজ। ভাটির এই জনপদকে আলোকিত করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এই প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন অনেক শিক্ষার্থী এখন দেশের গুণী মানুষ। এছাড়া মধ্যনগরে ৪ টি মাদ্রাসা ও ৮৫ টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে।
মধ্যনগরকে যেভাবে দেখতে চান স্থানীয়রা
সিলেট শহরে বসবাসরত মধ্যনগরের বাসিন্দাদের সংগঠন সিলেটস্থ মধ্যনগর থানা উন্নয়ন পরিষদের আহ্বায়ক আব্দুর রাজ্জাক ও মধ্যনগরের বাসিন্দা সিলেটের হযরত শাহজালাল হাইস্কুলের শিক্ষক আমিনুল ইসলাম বললেন, আমরা আনন্দিত-উচ্ছ্বসিত। মধ্যনগর থানা উপজেলায় উন্নীত হওয়ায় রুটিন কাজ নিশ্চয়ই সরকারই করবে। আমরা মনে করি পশ্চাৎপদ অঞ্চল এটি। রাষ্ট্রের অনেক সুবিধাই এই অঞ্চলবাসী পান না। স্বাস্থ্য-শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত মানুষ। যোগাযোগ ব্যবস্থায়ও অবহেলিত। মধ্যনগরে কমপক্ষে তিন টি হাইস্কুলকে সরকারিকরণ চাই আমরা। একটি ডিগ্রি কলেজ সময়ের দাবি। মধ্যনগর ১০ শয্যার মা ও শিশু কল্যাণ হাসপাতাল এবং ফুলেনন্নেছা মা ও শিশু কল্যাণ হাসপাতালের উপর এই বিশাল এলাকার মা ও শিশু চিকিৎসা নির্ভরশীল। এই দুটোই চলছে নার্সের মাধ্যমে। ওখানে ডাক্তারের পদায়ন চাই। ধর্মপাশা-বাঁকাতলা সড়কটি জরুরি সড়ক। এই সড়ক দিয়ে পায়ে হেঁটেই চলাচল দায় হয়ে পড়েছে। যোগাযোগের অব্যবস্থার জন্য মানুষ চিকিৎসার প্রয়োজনে নেত্রকোণার কলমাকান্দা যেতে হয়, যা বড়ই দুঃখজনক। আমরা মনে করছি সুমেশ^রী নদীর উপর মধ্যনগর সেতু এবং সীমান্ত সড়ক চালুর জন্য কাইতকান্দা অংশে সেতু হওয়া জরুরি।
সুনামগঞ্জ- ১ (ধরমপাশা, জামালগঞ্জ, তাহিরপুর ও মধ্যনগর) আসনের সাংসদ মোয়াজ্জেম হোসেন রতন বললেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মধ্যনগর থানাকে নিকার সভায় উপজেলা হিসেবে অনুমোদন দেওয়ায় দিনটি মধ্যনগরবাসীর জন্য স্মরণীয় দিন হয়ে থাকবে। এখন দ্রুত এই ঘোষণা বাস্তবায়নের জন্য আমরা কাজ করবো।’
সুনামগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য পরিকল্পনা মন্ত্রী এমএ মান্নান বললেন, দক্ষিণ সুনামগঞ্জের নামকরণ শান্তিগঞ্জ হওয়ায় এবং মধ্যনগর উপজেলা ঘোষণায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞ আমরা। আমি সাধ্যমত চেষ্টা করছি এজন্য কাজ করতে। ভবিষ্যতে সুনামগঞ্জের অবহেলিত এলাকার উন্নয়নে নানা পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের
কমেন্ট করুন